ঋণের টাকা পরিশোধ করতে না পেরে ১৬ মে চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জে গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেন আব্দুল মালেক নামে এক ক্ষুদ্র ফল ব্যবসায়ী।
তিনি ব্যবসা ও স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য কয়েকটি ব্যাংক এবং এনজিও থেকে ঋণ নিয়েছিলেন। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সংসার চালাতে হিমশিম খাওয়ায় দীর্ঘদিন তিনি ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে পারছিলেন না।
বিভিন্ন এনজিও থেকে নেওয়া ঋণের কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে না পেরে ৩০ মার্চ কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার ১৯নং ওয়ার্ডের রাজাপাড়ায় আত্মহত্যা করেন শামছুন্নাহার নামে এক নারী। প্রতিবেশীরা জানায়, ঋণের কিস্তির টাকা না পেয়ে এনজিও প্রতিষ্ঠান ‘বীজ’-এর কর্মকর্তারা ওইদিন সকালে তার বাড়িতে তালা লাগায়। ঘরের ভেতরে তালাবদ্ধ শামছুন্নাহার অপমান সহ্য করতে না পেরে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন।
একই দিন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে পাওনা টাকা ফেরত চাওয়ায় সারোয়ার মিয়া নামে এক যুবককে ছুরি মেরে হত্যা করে তারই দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। পুলিশ জানায়, মাত্র ১০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করতে পারছিলেন না অটোরিকশা চালক আল আমিন। এ নিয়ে তাদের বন্ধুত্বে ফাটল ধরে। এর এক পর্যায়ে তাকে কৌশলে নির্জন স্থানে ডেকে নিয়ে আরেক বন্ধুর সহযোগিতায় খুন করেন।
সমাজবিজ্ঞানী ও অর্থনীতিবিদরা জানান, খাদ্যদ্রব্যসহ সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের দাম আকাশ ছুঁয়েছে। বাসা ভাড়া, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যাতায়াতসহ প্রতিটি খাতেই জীবনযাত্রার খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে নিম্নমধ্যবিত্তের প্রকৃত আয় কমেছে। সংসার সামাল দিতে তাদের একটি বড় অংশকে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, প্রতিবেশী, স্থানীয় সমিতি ও বিভিন্ন এনজিও কাছ থেকে চড়াসুদে ঋণ নিতে হচ্ছে। যার সুদ পরিশোধ করাই তাদের জন্য দুষ্কর হয়ে পড়েছে। ফলে চক্রবৃদ্ধি হারে ঋণের অর্থ বাড়ছে। ঋণে ডোবা হতাশাগ্রস্ত মানুষ নির্বিচারে আত্মহত্যাসহ নানা ভয়ংকর পথ বেছে নিচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষার মতো মৌলিক চাহিদা মেটাতে দেশের এক-চতুর্থাংশ পরিবার ঋণ করে। শহরের চেয়ে গ্রামের মানুষই এজন্য বেশি ঋণ করছে। শহর ও গ্রামের মানুষ এ ঋণের বড় অংশই নিচ্ছে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) থেকে চড়াসুদে। দেশে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মাত্রা ও তার প্রভাব এবং খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা মোকাবিলায় মানুষের ঋণ গ্রহণ, অর্থ ব্যয়সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য উঠে এসেছে এ জরিপে। তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশের শূন্য দশমিক ৮২ শতাংশ পরিবার তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। আর ২২ শতাংশ পরিবার মাঝারি বা তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে। দেশে বর্তমানে মোট পরিবার বা খানার সংখ্যা ৪ কোটি ১০ লাখ। এর মধ্যে প্রায় ২৬ শতাংশ পরিবার মৌলিক চাহিদা পূরণে ঋণ করছে। খাদ্যের প্রয়োজন মেটাতে পরিবারপ্রতি গড় ঋণ বছরে প্রায় ৪৯ হাজার টাকা। এসব ঋণের বেশির ভাগই নেওয়া হচ্ছে এনজিও থেকে। গ্রাম, শহর ও সিটি করপোরেশন মিলিয়ে ঋণগ্রস্ত পরিবারগুলো ৬৮ শতাংশের বেশি ঋণ নেয় এনজিও থেকে চড়াসুদে। এর বাইরে আত্মীয়স্বজন, ব্যাংক, মহাজন বা অন্য উৎস থেকেও ঋণ করে পরিবারগুলো।
বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের ৭১ শতাংশ পরিবার খাদ্যের বাড়তি দাম নিয়ে উদ্বিগ্ন। এ কারণে মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের অনেক মানুষকে বাধ্য হয়ে ঋণ করতে হচ্ছে।
এদিকে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং বা সানেমের বিভিন্ন জরিপে যে তথ্য উঠে এসেছে তাতে বিবিএসের তথ্যের চেয়েও বেশি সংখ্যক পরিবার এখন খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে। চরম দারিদ্র্যের মধ্যে থাকা এসব পরিবারের পক্ষে ঋণ করে টিকে থাকাও ক্রমেই দুষ্কর হয়ে উঠছে।
সানেমের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, দেশে দেড় বছরের বেশি সময় ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। বাজারে পণ্যমূল্য যতটা বেড়েছে, সেই তুলনায় মানুষের আয় বাড়েনি। এ কারণে জীবনযাত্রার খরচ সামাল দিতে ঋণ করছে নিম্ন আয়ের মানুষ।
অর্থনীতিবিদরা জানান, ঋণের ফাঁদে শুধু নিম্নবিত্ত নয়, নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্তরাও আটকা পড়ে যাচ্ছে। প্রচলিত ব্যাংকের সুদ হার কম হলেও সেখান থেকে ঋণ পাওয়া সহজ নয়। ফলে তার উচ্চ সুদ হারে অপ্রচলিত, ব্যক্তি খাত এবং এনজিও থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হচ্ছেন। ওই ঋণের সুদ আর কিস্তি পরিশোধ করতে গিয়ে এখন তারা দিশেহারা।
রাজধানীর মুগদার ইজিবাইক চালক কামরুল জানান, দুটি এনজিও এবং স্থানীয় একটি সমিতি থেকে দেড় লাখ টাকা ঋণ নিয়ে ইজিবাইক কিনেছেন। প্রতি সপ্তাহে কিস্তি শোধ করতে হয় সাড়ে চার হাজার টাকা। ইজিবাইক চালিয়ে তার মাসে আয় হয় ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা। এর থেকে কিস্তি পরিশোধ করে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। তাই প্রায় প্রতি মাসেই দুই-তিনবার কিস্তি দিতে ব্যর্থ হচ্ছেন। এতে চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ বেড়ে ‘গোদের উপর বিষফোঁড়া’ হয়ে উঠছে।
এদিকে প্রাইভেট ফার্মের চাকরি হারিয়ে চলতি বছরের শুরুর দিকে রাজধানীর মানিকদির বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম এনজিও থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে স্ট্রিট ফুডের দোকান দিয়েছেন। পুলিশ, স্থানীয় রাজনৈতিক ক্যাডারদের চাঁদা ও ঋণের কিস্তির টাকা নিয়মিত পরিশোধ করে হাতে উদ্বৃত্ত তেমন কোনো টাকা থাকছে না। তাই আরও কিছু টাকা ঋণ নিয়ে অন্য কোনো ব্যবসা করা যায় কিনা সে পথ খুঁজছেন। তবে চড়াসুদে ঋণ নিয়ে পরিশোধ করতে না পারলে তা এক সময় গলার ফাঁস হয়ে দাঁড়াবে এমন শঙ্কায় সেদিকে এগোতে ভয় পাচ্ছেন।
সিরাজুল জানান, তার এক প্রতিবেশী স্থানীয় একটি সমিতি থেকে ৮০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে সময়মতো কিস্তি দিতে পারেননি। যা এখন সুদে-আসলে এক লাখ টাকা দাঁড়িয়েছে। এ টাকা পরিশোধ করতে না পেরে ওই সমিতির লোকজনের হাতে কয়েক দফা নির্যাতনের শিকার হন। এক পর্যায়ে তিনি ঋণ পরিশোধ না করেই পরিবার নিয়ে পালিয়ে যান।
অন্যদিকে এনজিও, সমবায় সমিতি ও ব্যাংকের ক্ষুদ্রঋণের টাকা পরিশোধ করতে না পেরে জেলে যাওয়া এবং ঋণদাতাদের হাতে প্রহৃত হওয়া মানুষের সংখ্যাও এখন দিন দিন বাড়ছে। এমনকি এ নিয়ে খুনোখুনির ঘটনাও ঘটছে। ঋণ খেলাপি মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ার ভয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বিপুল সংখ্যক মানুষ।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় উদ্দীপন নামে এক এনজিও থেকে নেওয়া ৩০ হাজার টাকা ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় গত ১৭ এপ্রিল জেলে যেতে হয় গৃহবধূ খালেদা আক্তারকে। অথচ কিস্তিতে প্রায় ২০ হাজার টাকা শোধ করেছিলেন তিনি। কিন্তু উচ্চমূল্যের বাজারে সংসার খরচ চালিয়ে চড়া সুদের টাকা পরিশোধ করতে পারছিলেন না। তাই তিন বছরের মেয়েকে রেখে খালেদাকে কারাবরণ করতে হয়।
এদিকে শুধু এনজিও থেকেই নয়, ব্যাংক থেকে সামান্য টাকা ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করতে না পেরে বিপুল সংখ্যক নিম্নবিত্ত মানুষ মামলার জালে জড়াচ্ছে। সারাদেশে সার্টিফিকেট মামলা এখন ১ লাখ ২৬ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে ১১ হাজার ৭৭২ জনের নামে। এসব মামলায় অভিযুক্তরা জনপ্রতি গড়ে ঋণ নিয়েছেন ৩০ হাজার টাকা।
অন্যদিকে ব্যাংক ঋণের মামলা থেকে বাঁচতে এনজিও এবং সমিতি থেকে টাকা ধার নিয়ে ব্যাংকের টাকা পরিশোধ করে ভয়ংকর ফাঁদে ফাঁসছেন হাজার হাজার মানুষ। তাদের চড়া সুদ পরিশোধ করতে গিয়ে অনেকে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। তাদের হয়রানির চাপ সহ্য করতে না পেরে কেউ কেউ আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোর কঠিন শর্ত মেনে নিম্ন-মধ্যবিত্তরা সহজেই ঋণ পান না। তাই তারা ব্ল্যাংক চেক দিয়ে সহজেই এনজিও এবং সুদি মহাজনের পাতা ভয়ংকর ফাঁদে পড়ছে। পরে আর তারা এই ফাঁদ থেকে বের হতে পারছেন না। ঋণের টাকা না দিতে পারায় অনেকে জেলেও যাচ্ছেন। মূলত সংসার চালাতেই এই ঋণ নিচ্ছেন।
তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে, এনজিওগুলো বছরে ১৪ থেকে ১৮ শতাংশ সুদ নেয়। কিন্তু সুদ আসল হিসাব করে প্রতি সপ্তাহে কিস্তি দিতে হয়। ওই টাকার ওপর চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ আসে। এতে প্রকৃত সুদের হার ২২ থেকে ২৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। ফলে ঋণের পুরো টাকা পরিশোধে অনেককে ভিটেমাটিও বিক্রি করতে হয়।
সুদি মহাজন ও বিভিন্ন সমিতির সুদের হার বছরে ৩০ থেকে ৩৬ শতাংশও নেওয়া হয় বলে তথ্য পাওয়া গেছে। বিশেষ করে গ্রামে এ ধরনের উচ্চ সুদে ঋণ বেশি দেওয়া হচ্ছে। এ ধরনের ঋণ দেওয়ার আগে জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে ঋণগ্রহীতার স্বাক্ষর নিয়ে রাখা হয়। ফলে কোনো কারণে তা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলেই মামলার ফাঁদে পড়তে হচ্ছে।
ইউএনডিপির বাংলাদেশের কান্ট্রি ইকোনমিস্ট ড. নাজনীন আহমেদ মনে করেন, খাদ্যসহ সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের উচ্চমূল্যের কারণে ঋণগ্রস্তরা বিপর্যস্ত। এর ওপর সম্প্রতি যেভাবে উচ্চহারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে তাতে পরিস্থিতি শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা এখন বড় উদ্বেগের বিষয়।
অর্থনীতিবিদের ভাষ্য, সাধারণ মানুষের ঋণগ্রস্ততা নিয়ে যে খবর পাওয়া যাচ্ছে তা চরম উদ্বেগের। করোনার সময় দারিদ্র্যের উল্লম্ফন হয়েছে। মানুষ ব্যক্তিগত পর্যায় ছাড়াও বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক উৎস থেকে ঋণ নিয়েছে। ওই ঋণ পরিশোধ করে মানুষ যখন ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল, ঠিক তখনই শহর ও গ্রামে সব ধরনের পণ্যের রেকর্ড মূল্যস্ফীতি ঘটে। এতে মানুষকে জেনে-শুনেই নতুন ঋণের ফাঁদ গলায় পরতে হচ্ছে। মানুষকে এই ঋণ ফাঁস থেকে রক্ষা করতে সরকারের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে অতিদরিদ্রের পাশাপাশি নতুন করে দরিদ্রের সারিতে যুক্ত হওয়া মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। তা না হলে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেবে।