আরবি ভাষায় একেবারেই “কেবলা হেকিম” চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাটের রবিউল আওয়াল।
এই ভাষা তিনি বলতে বা বুঝতেও পারেন না, পড়া কিংবা লেখা তো দূরের কথা। দালালের প্রলোভনে স্বচ্ছলতার আশায় সৌদি আরবে পাড়ি জমানো রবিউলের তাই দেশটিতে গিয়ে প্রথমে কাজ পেতে সমস্যা হয়। বহু কাঠ-খড় পুড়িয়ে কাজ মিললেও মাস শেষে সাকুল্যে পেতেন ৮০০ রিয়াল, বাংলাদেশি টাকায় যা ২৪ হাজার টাকা।
অথচ ভাষাদক্ষতা থাকায় একই কাজ করে অন্য এক শ্রমিক মজুরি পান ১,৭০০ রিয়াল। ধীরে ধীরে নিজের চেষ্টায় প্রায় পাঁচ মাসে রবিউল আরবি শেখেন। এখন তিনি একটি ফার্মেসিতে ১,৮০০ রিয়াল বা ৫৪ হাজার টাকা বেতনে কাজ করেন।
রবিউলের মতো হাজারো শ্রমিক প্রতি বছর ভাষা না শিখেই বিদেশে পাড়ি জমান। যাদের অধিকাংশ স্বল্প মজুরিতে চাকরি করেন। অনেকে আশানুরূপ বেতন না পেয়ে ফিরে আসেন দেশে। তবে সরকারিভাবে প্রশিক্ষণ নিয়ে বিদেশে গেলে এমন সমস্যা হয় না।
মধ্যপ্রাচ্য বড় গন্তব্য, ভাষা না জানলে বিপদ
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) বলছে, ২০২৩ সালে বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরবে ৪ লাখ ৯৭ হাজার ৬৭৪, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৯৮ হাজার ৪২২, কুয়েতে ৩৬ হাজার ৫৪৮, ওমানে ১ লাখ ২৭ হাজার ৮৮৩, কাতারে ৫৬ হাজার ১৪৮ জন শ্রমিক গেছেন। সবগুলো দেশের ভাষাই আরবি। বছরে এত শ্রমিক গেলেও তাদের ভাষা প্রশিক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে তারা কর্মক্ষেত্রে ভোগান্তিসহ ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশে বিদেশি ভাষা প্রশিক্ষণের সরকারি প্রতিষ্ঠান একেবারেই নগণ্য। শহরে কিছু প্রতিষ্ঠান থাকলেও উপজেলা পর্যায়ে নেই বললেই চলে। ফলে বিদেশগামী শ্রমিকরা ভাষা শিখতে অনীহা দেখান। বিদেশে যাওয়ার পর তারা বিষয়টি বুঝতে পারেন।
দেশে সরকারিভাবে জাপানি, কোরিয়ান, ইংরেজি এবং চাইনিজ ভাষা শিক্ষার প্রতিষ্ঠান থাকলেও আরবি ভাষা শিক্ষার তেমন কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের অধীনে স্বল্পমেয়াদি আরবি ভাষা কোর্সে ভর্তির সুযোগ থাকলেও সবার জন্য তা প্রযোজ্য নয়। সেখানে ভর্তি হতে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণের সনদ থাকতে হয়। যা বেশিরভাগ শ্রমিকেরই নেই।
বিএমইটি বলছে, ২০২৩ সালে ১৩ লাখ ৫ হাজার ৪৫৩ জন মানুষ দেশ থেকে চাকরির জন্য পাড়ি জমিয়েছেন বিদেশে। তাদের মধ্যে ৮ লাখ ১৬ হাজার ৬৭৫ জন অর্থাৎ ৬২.৫৬% গেছেন মধ্যপ্রাচ্যের আরবিভাষী দেশগুলোতে।
আরবি ভাষা প্রশিক্ষণের কেন্দ্র কম
প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় বলছে, দেশে জাপানি ভাষা শিক্ষার কেন্দ্র রয়েছে ৪৩টি, ৩২টি কোরিয়ান, ১৬টি ইংরেজি আর চীনা ভাষা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে ৪টি। তবে আরবি ভাষা শিক্ষার কোনো প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নেই। অথচ ২০২৩ সালে সবচেয়ে বেশি প্রবাসী গেছেন সৌদি আরবে।
২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীন জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর আওতায় দেশজুড়ে ৯৫টি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে চারটি দেশের ভাষা শিক্ষা দেওয়া হয়। ছয় মাস মেয়াদে ৮০০ জন জাপানি ভাষা শিখেছেন। এছাড়া ছয় মাস মেয়াদে কোরিয়ান ভাষা শিখেছেন ৮০৫ জন, দুই মাস মেয়াদে ইংরেজি শিখেছেন ৭২৮ জন এবং তিন মাস মেয়াদে চীনা ভাষা শিখেছেন ৯০ জন। গত অর্থবছরে মোট ভাষা প্রশিক্ষণার্থীর সংখ্যা ২ হাজার ৪২৩। অথচ ওই সময় প্রায় ১৩ লাখ শ্রমিক বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন।
বিএমইটি বলছে, এখন দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান ও হংকংয়ের বিধিমালা মেনে শ্রম অভিবাসনের জন্য ভাষা পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তাই এসব অঞ্চলে গিয়ে বাংলাদেশি কর্মীদের কোনো জটিল পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে না।
এদিকে, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জনশক্তি রপ্তানি গন্তব্য মধ্যপ্রাচ্যে গমনেচ্ছু নারী গৃহকর্মীদের এক মাসের বাধ্যতামূলক আরবি ভাষার প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। তবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, আরবি শেখার জন্য তা মোটেও যথেষ্ট নয়।
ভাষাই শক্তি
এ বিষয়ে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর পরিচালক (প্রশিক্ষণ পরিচালনা) মো. সালাহ উদ্দিন বলেন, সাত বছর আগে আরবি ভাষা শিক্ষা কোর্স ছিল। শুরুর দিকে কিছুটা সাড়া মিললেও পরে শিক্ষার্থী কমে যায়। এজন্য এখন কোর্সটি বন্ধ। সৌদি আরবে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভাষা শিক্ষা বাধ্যতামূলক না হওয়ায় শ্রমিকরা আগ্রহ দেখান না।
তিনি বলেন, ‘‘সম্প্রতি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী সারাদেশে আবার আরবি ভাষা কোর্স চালুর জন্য আমাদের নির্দেশনা দিয়েছেন। আমরা সেই মোতাবেক কাজ শুরু করেছি।’’
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ও মাইগ্রেশন বিশেষজ্ঞ ড. সৌমিত চন্দ জয়দ্বীপ জানান, “শ্রমবাজারে ভাষাজ্ঞান একটি শক্তি। শুধুমাত্র ভাষা ভালো জানার জন্য আমাদের দেশের কর্মীদের তুলনায় ফিলিপাইন, ভারত ও শ্রীলঙ্কার কর্মীদের বেতন দ্বিগুণ বা তার চেয়েও বেশি।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান বলেন, “অল্প শিক্ষিত ও অদক্ষ জনগোষ্ঠীর বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা বেশি। সরকারি ব্যবস্থাপনায় ভাষা শিক্ষার সুযোগ কম। এই সুযোগে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো অদক্ষদের বিদেশে পাঠাচ্ছে। তাই সরকারকেই প্রাথমিকভাবে বড় উদ্যোগ নিতে হবে; যাতে শ্রমিকরা ভাষাদক্ষতা অর্জন করেই বিদেশে যেতে পারেন।”