দেশের যোগাযোগ খাতে নতুন এক দিগন্তের উন্মোচন হতে যাচ্ছে কাল। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু টানেল উদ্বোধনের মাধ্যমে টানেলের যুগে প্রবেশ করছে বাংলাদেশ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের অর্থনীতিতে অভাবনীয় এক পরিবর্তন আনবে এ টানেল। এতে চট্টগ্রাম মূল শহরের সঙ্গে সাগর ও বিমানবন্দরের দূরত্ব কমে আসবে। বাঁচবে অতিরিক্ত খরচ ও সময়। মাত্র ৩ মিনিটেই পাড়ি দেওয়া যাবে কর্ণফুলী নদী।
অর্থনীতির গতিপথ আরও গতিশীল করতে এ টানেল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। আগামীকাল (শনিবার) দেশের প্রথম এ টানেল উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে পরদিন (রবিবার) ভোর ৬টায়।
এদিকে গতকাল রাজধানীর বনানীতে সেতু ভবনে এক ব্রিফিংয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানান, ২৮ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টানেল উদ্বোধন করার পর আনোয়ারা প্রান্তে ইপিজেড মাঠে সুধী সমাবেশে বক্তব্য দেবেন।
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের অধীনে এর মধ্যে টানেলের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। যার বর্ণাঢ্য উদ্বোধন হবে শনিবার।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এ টানেলের মাধ্যমে দেশের শিল্পায়ন, পর্যটন, অর্থনীতিসহ অন্যান্য খাতে নতুন মাত্রা যুক্ত হচ্ছে। টানেল চালু হওয়ার ফলে দেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি বাড়বে শূন্য দশমিক ১৬৬ শতাংশ।
টানেলটি পুরোদমে চালু হলে প্রতিদিন গড়ে ১৭ হাজার ২৬০টি গাড়ি চলাচল করবে। বছরে সে সংখ্যা গিয়ে দাঁড়াবে ৬৩ লাখে।
২০২৫ সালে টানেল দিয়ে গড়ে প্রতিদিন ২৮ হাজার ৩০৫টি যানবাহন চলাচল করবে। যার অর্ধেক পণ্যবাহী যানবাহন। ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতিদিন গড়ে ৩৭ হাজার ৯৪৬টি এবং ২০৬৭ সাল নাগাদ ১ লাখ ৬২ হাজার যানবাহন চলাচলের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা আছে। অন্যদিকে গতকাল প্রকল্প এলাকা সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, টানেলের দুই প্রান্তেই প্রস্তুতি সম্পন্ন। জনসমাবেশের প্রস্তুতিও সম্পন্ন। টানেলটির প্রকল্প পরিচালক, চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসকসহ দায়িত্বশীল ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা টানেল স্থান পরিদর্শন করেন। একই সঙ্গে ঢাকা ও চট্টগ্রামের সাংবাদিকদের একটি প্রতিনিধি দলও সরেজমিন ঘুরে দেখেন।
প্রকল্প পরিচালক হারুনুর রশিদ জানান, ঝুঁকির মধ্যেই নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে এটির। কর্ণফুলী নদীর মাটি নরম থাকায় তলদেশে বোরিংকালে বেশ বেগ পেতে হয়। ১৬টি কাউন্টার আছে টানেলের টোল প্লাজার। ওজন স্কেল আছে ছয়টি।
জেলা প্রশাসক এ বি এম ফখরুজ্জামান জানান, খরস্রোতা হওয়ায় কর্ণফুলী নদীতে টানেল স্থাপন কাজ ছিল চ্যালেঞ্জিং। মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দরের সুফল আদায়েও এ টানেল ভূমিকা রাখবে। ‘চট্টগ্রামের উন্নয়নের দায়িত্ব আমি নিজের কাঁধে তুলে নিলাম’, প্রধানমন্ত্রীর এমন ঘোষণা এখনো চট্টগ্রামবাসী ভোলেনি।
চট্টগ্রামের নাগরিকসমাজ মনে করে, কথা রেখেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চট্টগ্রামে একের পর এক অর্থনৈতিক গুরুত্বসম্পন্ন মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করে প্রধানমন্ত্রী তাঁর কথা রেখেছেন বলে জানান বিশিষ্ট সমাজসেবী, একুশে পদকপ্রাপ্ত শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. অনুপম সেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষাবিদ ও পরিবেশবিষয়ক গবেষক প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইদ্রিস আলী বলেন, ‘টানেল চালু হলে বাংলাদেশ উন্নয়ন ও মর্যাদার নতুন স্বর্ণদ্বারে প্রবেশ করবে।’
ওয়ান সিটি টু টাউন : চীনের সাংহাই শহরের আদলে চট্টগ্রামকে গড়ে তোলার লক্ষ্যেই এ টানেল, যা চট্টগ্রাম শহরের পতেঙ্গা ও আনোয়ারাকে যুক্ত করবে। একই সঙ্গে নদীর তলদেশ দিয়ে কম সময়ে দুটি আলাদা এলাকায় যাতায়াত সুবিধা পাবে। শুধু তাই নয়, এটি চালু হলে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের মধ্যে আধুনিক যোগাযোগ সংযোগ গড়ে উঠবে।
এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে টানেলটি সংযোগ স্থাপন করবে বলে জানিয়েছেন দায়িত্বশীলরা। টানেল ঘিরে চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের পর্যটন শিল্পের আরও বিকাশ হবে উল্লেখ করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের চট্টগ্রাম মহানগর সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিন বলেন, বঙ্গবন্ধু টানেল জিডিপিতেও ভূমিকা রাখবে।
নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি আশিক ইমরান বলেন, বঙ্গবন্ধু টানেলের ফলে কর্ণফুলী নদীর পূর্বপ্রান্তের অর্থাৎ দক্ষিণ চট্টগ্রামে প্রস্তাবিত শিল্প এলাকার ব্যাপক উন্নয়ন হবে। পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত চট্টগ্রাম শহরের যোগাযোগেও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। ঢাকা হয়ে সড়কপথে কক্সবাজার পর্যন্ত যোগাযোগ পাবে নতুন গতি।
২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টানেলটির নির্মাণকাজ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন। প্রায় ৩০ বছর আগে চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর মেয়র নির্বাচনে অন্যতম দফা ছিল নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ।
জাতীয় অগ্রগতিতে অসামান্য অবদান রাখা স্বপ্নজাগানিয়া এ টানেল উদ্বোধনের অপেক্ষায় আছে চট্টগ্রামসহ দেশের মানুষ। এ ছাড়া টানেল চালু হলে নির্মাণাধীন দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর ও মহেশখালীর আগামীর বাণিজ্যিক হাবের সঙ্গে যুক্ত হবে পুরো দেশ। নির্মাণাধীন রয়েছে গভীর সমুদ্রবন্দর, এলএনজি টার্মিনাল, এলপিজি টার্মিনাল, অয়েল টার্মিনাল, গ্যাস ট্রান্সমিশন, অয়েল রিফাইনারি, এনার্জি ও ফুড স্টোরেজ, ট্যুরিজম, এমব্যাঙ্কমেন্ট ও ওয়াটারফ্রন্ট ইকোনমিক জোন।
এ মেগা প্রকল্পগুলোয় বিভিন্ন এলাকা থেকে পণ্য আনা-নেওয়ার জন্য প্রতিদিন চলাচল করবে শত শত গাড়ি; যা বঙ্গবন্ধু টানেলকে যাতায়াতের সহজ মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করবে। এ টানেল শুধু দেশের যোগাযোগব্যবস্থায় নয়, দক্ষিণ এশিয়ার যোগাযোগব্যবস্থায় প্রভাব ফেলবে।
এ টানেলের মাধ্যমে দেশ যুক্ত হবে এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল উদ্বোধন উপলক্ষে চট্টগ্রামে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগমন উৎসবমুখর করতে সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগ রয়েছে। শহর প্রান্তে টানেল উদ্বোধন শেষে আনোয়ারার জনসভায় বক্তব্য দেবেন প্রধানমন্ত্রী।