চট্টগ্রাম মেডিকেলের ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিচ্ছেন হাটহাজারীর বাসিন্দা ৭০ বছরের মঈনউদ্দিন। ডেঙ্গু ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই তার রক্তের প্লাটিলেট কমতে শুরু করেছে। উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি এবং হার্টের সমস্যাও রয়েছে। চিকিৎসা চলাকালীন সময়ে তার অন্যান্য সমস্যা প্রকট হয়ে উঠেছে। গত দু’দিন ধরে শুরু হয়েছে বুকে ব্যথা।
মঈনউদ্দিনের ছেলে মোবারক বলেন, ‘আব্বার অন্যান্য সমস্যা সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। ডাক্তাররা বলেছেন, প্লাটিলেট বাড়ার পরই রোগীর অন্য চিকিৎসা শুরু করতে পারবেন।’
মঈনউদ্দিনের মতো চট্টগ্রাম মেডিকেলের ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি আছেন আরও অনেক রোগী। ডেঙ্গু আক্রান্ত প্রায় সব রোগীরই রক্তে প্লাটিলেটের সমস্যা। রক্ত দিতে হচ্ছে এসব রোগীকে।
চট্টগ্রামে ডেঙ্গু ভয়াবহ আকার ধারন করছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ৮১ জন। তবে মারা যায়নি কেউ। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ৯ জুলাই পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ৮৫৯ জন। এর মধ্যে মহানগরে ৬১২ জন, উপজেলায় ২৪৭ জন। মৃত্যু হয়েছে ১৩ জনের। শুধুমাত্র জুলাইয়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ২৯৫ জন।
ডাক্তাররা জানান, ডেঙ্গু রোগীদের দ্রুত প্লাটিলেট কমে যাচ্ছে। অনেকের অবস্থার দ্রুত অবনতি হচ্ছে। হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের বড় অংশের রক্ত লাগছে এবং কেউ কেউ শকে চলে যাচ্ছেন। এদের অনেককে আর ফেরানো যাচ্ছে না। প্লাটিলেট কমার সঙ্গে সঙ্গে রোগীর নানা শারীরিক জটিলতাও দেখা দিচ্ছে।
ডাক্তাররা আরও জানান, প্লাটিলেট কমে গেলে দাঁতের মাড়ি, নাক দিয়ে ও পায়খানার সঙ্গেও রক্তপাত হবে। প্রেসার ফলও করতে পারে। তাই যে কারও জ্বর হলে কোনোভাবেই অবহেলা করা যাবে না। ডেঙ্গু টেস্ট এবং প্লাটিলেট কাউন্ট অবশ্যই করিয়ে নিতে হবে।
চট্টগ্রাম মেডিকেলের ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন আছেন রত্না (ছদ্মনাম)। দ্বিতীয়বারের মতো ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১৮ দিন ধরে চিকিৎসা নিচ্ছেন তিনি। এর মধ্যে তার দু’বার ঋতুস্রাব হয়েছে। আর এতে রক্তপাতও হয়েছে বেশি। এরপর তার রক্তের প্লাটিলেট কমে গেছে। পরে তাকে রক্ত দিতে হয়েছে।
চট্টগ্রামের পটিয়ার ভাটিখাইন গ্রামের নূরুল হকের ছেলে নিরবের তিনদিনের বেশি সময় ধরে জ্বর ছিল। কিন্তু ছেলে ডেঙ্গু আক্রান্ত ও তার যে প্লাটিলেট কমে যাচ্ছে, তা জানতেন না নূরুল হক। স্থানীয় একটি ক্লিনিকে ভর্তি করালে সেখানে ডাক্তার রক্ত পরীক্ষা দেন। নিরবের জ্বরের সঙ্গে বমি, পাতলা পায়খানাও ছিল। পরীক্ষায় দেখা গেছে, তার প্লাটিলেট নেমে গেছে ২০ হাজারে। ওইদিনই চট্টগ্রাম মেডিকেলে নিয়ে আসেন ছেলেকে। মেডিকেলে ডাক্তার বলেছেন রক্ত ম্যানেজ করে রাখতে।
চট্টগ্রাম মেডিকেলের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. অনিরুদ্ধ ঘোষ জয় বলেন, ‘প্লাটিলেটের সংখ্যা ২০ হাজারের নিচে নেমে এলে কোনও আঘাত ছাড়াই রক্তক্ষরণ হতে পারে। প্লাটিলেট ১০ হাজারের নিচে নামা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। এই সময় শরীরের যে কোনও জায়গা থেকে অনবরত রক্তপাত হওয়ার সর্বোচ্চ ঝুঁকি থাকে।’
চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসাপাতালের শিশু বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. ফাহিম রেজা বলেন, ‘যে শিশুগুলো খারাপ অবস্থার দিকে চলে যাচ্ছে, বেসিক্যালি তাদের রক্তের প্লাটিলেট কমে যাচ্ছে। আমরা তাদের আইসিইউ বা এইচডিইউতে রাখার চেষ্টা করছি। কারণ প্লাটিলেট কমে যাওয়ার পাশাপাশি প্রেসারও কমে যাচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বোনম্যারো প্লাটিলেট তৈরি করে। কোনো কারণে প্লাটিলেট কমে গেলে বোনম্যারো তা আট ঘণ্টার মধ্যে পূরণ করে দেয়। কিন্তু এবার প্লাটিলেট দ্রুত কমছে, বোনম্যারো তা পূরণ করতে পারছে না। অনেকের ক্ষেত্রে লক্ষণ বুঝে ওঠার আগেই প্লাটিলেট কমে যাচ্ছে।’
মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. জসীম উদ্দিন বলেন, ‘প্লাটিলেট কমে যাওয়ার বিষয়টি অনেক ক্ষেত্রে রোগী বুঝতেই পারছেন না। সেজন্য জ্বর হলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। যে কারও জ্বর হলে কোনোভাবেই অবহেলা করা যাবে না। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ডেঙ্গু টেস্ট এবং প্লাটিলেট কাউন্ট অবশ্যই করিয়ে নেবেন। প্লাটিলেট কমেছে কী-না, তা পরীক্ষা না করে জানা অসম্ভব। শুরু থেকেই সতর্ক থাকলে ঝুঁকিগুলো এড়ানো যায়।’
তিনি বলেন, ‘ডেঙ্গু রোগীর প্লাটিলেট বেশি কমে গেলে দাঁতের গোড়া থেকে, বমির সঙ্গে, পায়খানার সঙ্গে বা শরীরের যে কোনো অঙ্গ থেকে রক্তরক্ষণ হয়। পেটে, বুকে পানি জমে যায়। ফলে রোগী শকে চলে যেতে পারে, মৃত্যুও হতে পারে। ঝুঁকি এড়াতে প্লাটিলেট এক লাখের নিচে নামলেই রোগীকে হাসপাতালে নেওয়া উচিত।’