উড়ালপথের মেট্রোরেল লাইন-৬ চালুর পর ঢাকাবাসীকে নতুন স্বপ্ন দেখাচ্ছে পাতালরেল প্রকল্প।
এটি হবে যোগাযোগ খাতের আরেক নতুন সংযোজন। যার মাধ্যমে পাতালরেলের (সাবওয়ে) যুগে প্রবেশ করবে বাংলাদেশ।ইউরোপ-আমেরিকা জুড়ে পাতালরেল বা সাবওয়ে খুবই সফল ও জনপ্রিয় একটি যোগাযোগব্যবস্থা। বাংলাদেশেও এ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। ২০২৬-এর ডিসেম্বরেই পাতালরেলে চড়ার সুযোগ পাবেন ঢাকাবাসী। সেই পরিকল্পনা সামনে রেখে এ প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের ভূমি অধিগ্রহণ কাজ প্রায় শেষের পথে। অর্থায়নকারী ও নির্মাতা প্রতিষ্ঠান জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) বলছে মাটির নিচের কাজে জটিলতা কম। বৈশ্বিক কোনো ধাক্কা না এলে এবং স্থানীয় রাজনৈতিক পরিবেশ স্থিতিশীল থাকলে নির্ধারিত সময়ের আগেই পাতালরেল (সাবওয়ে) নির্মাণ শেষ করা সম্ভব বলে মনে করে জাইকা। ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানান, মেট্রোরেল লাইন-১-এর যে অংশ মাটির নিচ দিয়ে চলবে সেটিই পাতালরেল বা সাবওয়ে নামে পরিচিতি পেতে যাচ্ছে। সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে এ প্রকল্পটির বাস্তবায়ন শেষ করার কথা রয়েছে। গত সেপ্টেম্বর শেষে প্রকল্পটির ভূমি উন্নয়ন কাজের অগ্রগতি ২৭ শতাংশ। ১২টি প্যাকেজে পুরো প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হবে। এমআরটি লাইন-১ বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৫২ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৩৯ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা সহায়তা দেবে জাপান। আর বাকি খরচ মেটানো হবে সরকারি তহবিল থেকে।
বিমানবন্দর, কমলাপুরসহ প্রকল্প এলাকা সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত প্রস্তাবিত পাতালরেল (এমআরটি লাইন-১) প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের ভূমি অধিগ্রহণ কার্যক্রম শেষের পথে। প্রকল্পটিতে প্রথম দফায় প্রায় ৯৭ একর জমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব ছিল। কর্মকর্তারা জানান, পিতলগঞ্জ ডিপো ও ডিপো এক্সেস করিডরের জন্য ৯৭ দশমিক ৯৭ একর ভূমি অধিগ্রহণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এ প্রকল্পটির জন্য অতিরিক্ত ভূমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।
সূত্র জানান, পিতলগঞ্জে এ প্রকল্পের ডিপো উন্নয়নের কাজ এগিয়ে চলেছে। বিমানবন্দরের নবনির্মিত থার্ড টার্মিনালের যাত্রীদের পূর্ণ সুবিধা পাতালরেলের কাজ দ্রুত শেষ করা হবে। কেননা এ মেট্রোরেল লাইন-১ সরাসরি যুক্ত হবে থার্ড টার্মিনালের সঙ্গে। এজন্য পাতালরেলের কাজ দ্রুত করার নির্দেশনা দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।
জানা গেছে, অত্যাধুনিক সুযোগসুবিধাসংবলিত থার্ড টার্মিনালকে পূর্ণতা দিতে এ পাতালরেলের কাজ দ্রুত করার নির্দেশনা দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক যাত্রীরা থার্ড টার্মিনাল থেকে বেরিয়ে শহরে ঢুকতে পারবেন পাতালরেলের মাধ্যমে। আবার পাতালরেলের মাধ্যমে থার্ড টার্মিনাল ধরে ফ্লাই করতে পারবেন। এতে একদিকে যোগাযোগব্যবস্থা হবে অত্যন্ত স্বাচ্ছন্দ্যের। অন্যদিকে সময়েরও সাশ্রয় হবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
জানা গেছে, মেট্রোরেল লাইন-১-এর আওতায় দুটি রেললাইন নির্মাণ করা হচ্ছে। একটি লাইন হযরত শাহজাহাল (রহ.) বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ১৯ দশমিক ৮৭ কিলোমিটার অংশ। এটি মাটির নিচ দিয়ে যাবে। আর নতুন বাজার থেকে পূর্বাচল পর্যন্ত ১১ দশমিক ৩৬ কিলোমিটার রেললাইন উড়ালপথে যাবে। প্রকল্প বাস্তবায়নে খরচ ধরা হয়েছে ৫২ হাজার কোটি টাকা। প্রকল্পের মেয়াদ বাস্তবায়নের মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০২৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত।
ডিএমটিসিএলসূত্র জানান, ঢাকা শহরের মানুষের চলাচলের জন্য দেশের প্রথম পাতালরেলের ডিপো নির্মাণ করা হচ্ছে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের চিতলগঞ্জে। লাইন-৬ বাস্তবায়নের সুফল ইতোমধ্যে ঢাকাবাসী পেতে শুরু করেছেন। উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেল নিয়মিতভাবে যাতায়াত করছে। আশা করা হচ্ছে ডিসেম্বরের মধ্যে মতিঝিল পর্যন্ত চালু হবে মেট্রোরেল লাইন-৬। একইভাবে লাইন-১ বাস্তবায়নের কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। তবে লাইন-৬ বাস্তবায়নের বেলায় ঢাকাবাসীকে যে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে সে দুর্ভোগ পোহাতে হবে না পাতালরেল নির্মাণের ক্ষেত্রে। কেননা পাতালরেলের লাইন স্থাপনের সব ধরনের কাজই সম্পন্ন হবে মাটির নিচে। ফলে মাটির ওপরে তেমন কোনো প্রভাব পড়বে না। এ ছাড়া পৃথিবীর যেসব শহরের মেট্রোরেল সফল ও জনপ্রিয় তার বেশির ভাগই মাটির নিচে। অবশ্য সেগুলো সাবওয়ে নামে পরিচিত।
ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএএন সিদ্দিক বলেন, এমআরটি লাইন-১-এর নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে; যা থার্ড টার্মিনালের সঙ্গে যুক্ত হবে। এর মাধ্যমে ঢাকার যোগাযোগব্যবস্থায় এক ধরনের যুগান্তকারী পরিবর্তন আসবে বলে তিনি মনে করেন। ইতোমধ্যে এ প্রকল্পের ডিপো উন্নয়নের কাজ শুরু হয়েছে। ভূমি অধিগ্রহণ কাজও এগিয়ে চলেছে দ্রুতগতিতে।
ডিএমটিসিএলের ওয়েবসাইটে থাকা লাইন-১-এর অগ্রগতি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এমআরটি লাইন-১ প্রকল্পের দুটি লাইন থাকবে। হযরত শাহজালাল (রহ.) বিমানবন্দর থেকে মাটির নিচ দিয়ে কমলাপুর পর্যন্ত এ পাতালরেলের স্টেশন থাকবে ১২টি। স্টেশনগুলোর নির্ধারিত জায়গাগুলোর মধ্যে রয়েছে : কমলাপুর, রাজারবাগ, মালিবাগ, রামপুরা, আফতাবনগর, বাড্ডা, উত্তর বাড্ডা, নতুন বাজার, নর্দা, খিলক্ষেত, বিমানবন্দর টার্মিনাল-৩ ও বিমানবন্দর। আর এমআরটি লাইন-১-এর অন্য অংশ নতুন বাজার থেকে পূর্বাচল পর্যন্ত উড়ালপথে। স্টেশন থাকবে সাতটি। সেগুলোর নির্ধারিত জায়গা হলো : জোয়ারসাহারা, বোয়ালিয়া, মস্তুল, শেখ হাসিনা ক্রিকেট স্টেডিয়াম, পূর্বাচল সেন্ট্রাল, পূর্বাচল পূর্ব ও পূর্বাচল টার্মিনাল। এমআরটি লাইন-১ প্রকল্পের দৈর্ঘ্য হবে ৩১ দশমিক ২৪১ কিলোমিটার। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে মোট খরচ হবে ৫২ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৪০ হাজার কোটি টাকা দিচ্ছে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)। বাকি ১২ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা খরচ করবে বাংলাদেশ সরকার। ২০২৬ সালে প্রকল্পের কাজ শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
এমআরটি লাইন-১ চালু হলে এ রুটে প্রতিদিন ৮ লাখ যাত্রী চলাচল করতে পারবে। বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর যেতে লাগবে ২৪ দশমিক ৩০ মিনিট। আর নতুন বাজার থেকে পূর্বাচল যেতে লাগবে ২০ দশমিক ৩৫ মিনিট। এমআরটি লাইন-১-এর প্রতিটি পাতাল স্টেশন হবে তিন তলা। টিকিট কাউন্টার ও অন্যান্য সুবিধা থাকবে প্রথম বেসমেন্টে। প্ল্যাটফরম থাকবে দ্বিতীয় বেসমেন্টে। আর উড়াল স্টেশনের টিকিট কাউন্টার এবং প্ল্যাটফরম থাকবে তিনতলায়। যাত্রীদের চলাচলের জন্য উড়াল ও পাতাল দুই পথের স্টেশনেই থাকবে লিফট, সিঁড়ি ও এস্কেলেটর সুবিধা। স্টেশনগুলোয় পর্যাপ্ত বাতাস ও অক্সিজেনের প্রবাহ ঠিক রাখতে থাকবে অতিরিক্ত ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা।