হুমায়ূন আহমেদের “বৃক্ষমানব”, অথবা “ঘোড়া মজিদ”, প্রথমদিকে এই নামগুলোতেই জনপ্রিয়তা পেলেও এমন আরও অনেক নামে পরিচিত অভিনেতা আহমেদ রুবেল।
সফলতার একের পর এক সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠার মাঝপথে আকস্মিকভাবে যেন যবনিকাপাত ঘটল তার জীবন গল্পের। ৭ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন ৫৫ বছর বয়সী এই অভিনয়শিল্পী।
বসুন্ধরা সিটিতে অবস্থানকালে হঠাৎ পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পাওয়ায় সেখানে থেকে দ্রুত তাকে স্কয়ার হাসপাতালের নেওয়া হয়। কর্তব্যরত ডাক্তার জানান, হাসপাতালে আনার পথেই মৃত্যু হয়েছে আহমেদ রুবেলের। গুণী অভিনেতার এমন অকাল প্রয়াণে শোকের ছায়া নেমে এসেছে গোটা মিডিয়া পাড়ায়।
আহমেদ রুবেলের অভিনয় জীবন
১৯৬৮ সালের ৩ মে রাজশাহীর চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার রাজারামপুর গ্রামে জন্ম আহমেদ রাজিব রুবেল ওরফে আহমেদ রুবেলের। অভিনয়ের হাতেখড়ি হয়েছিল প্রখ্যাত নাট্যকার ও গবেষক সেলিম আল দীনের নাট্যদল “ঢাকা থিয়েটার”-এর মাধ্যমে। মঞ্চে তার অভিনীত প্রথম নাটক ছিল সেলিম আল দীনের “হাতহদাই”।
নাটকের মানুষ হলেও চলচ্চিত্রে ডাক পেয়ে যান রুবেল। ১৯৯৩ সালে নাদিম মাহমুদ পরিচালিত “আখেরি হামলা”-এর ছোট্ট একটি চরিত্র দিয়ে বড় পর্দায় তার পথচলা শুরু হয়। এরপর থেকে বাণিজ্যিক ছবিসহ একে একে মোট ছয়টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করে ফেলেন। এর মধ্যে কয়েকটিতে তিনি খলনায়কের ভূমিকায়ও অভিনয় করেছিলেন।
মঞ্চের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা তখনও ছিল। “বনঘাসফুল” নামের মঞ্চ নাটকে কাজ করার সময় তার পরিচয় হয় নাট্যপরিচালক আতিকুল হকের সঙ্গে। তার মাধ্যমেই রুবেলের অভিষেক ঘটে টেলিভিশন নাটকে।
গিয়াস উদ্দিন সেলিমের “স্বপ্নযাত্রা” নাটকের মাধ্যমে তিনি প্রথমবারের মতো টিভি দর্শকদের সামনের হাজির হন। এরপরেই তিনি সুযোগ পান গল্পের যাদুকর হুমায়ুন আহমেদের নাটকে কাজ করার। ঈদ নাটক “পোকা”-তে তার অভিনীত “ঘোড়া মজিদ” চরিত্রটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। এরপর থেকে তিনি হুমায়ূন আহমেদের নাটক ও চলচ্চিত্রের নিয়মিত অভিনয় শিল্পীদের একজন হয়ে ওঠেন।
তন্মধ্যে ২০০৩ সালে “চন্দ্রকথা” সিনেমায় তার কাজ মিডিয়া ব্যক্তিত্বদের নজর কাড়ে। এখানে “আমিন” চরিত্রের জন্য ২০০৪ সালে সমালোচকদের বিচারে তিনি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র অভিনেতা হিসেবে মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার পান। একই বছরে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক ছবি “শ্যামল ছায়া”-তেও নিজের অভিনয় দিয়ে তিনি মুগ্ধতা ছড়ান ভক্তদের মাঝে।
সে বছরই তিনি অভিনয় করেন ভিন্ন ধারার চলচ্চিত্রকার মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর “ব্যাচেলর” ছবিতে। জনপ্রিয় সিনেমাটির গল্প লিখেছিলেন প্রসিদ্ধ সাংবাদিক ও সাহিত্যিক আনিসুল হক। রুবেল কাজ করেছেন প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক মুহম্মদ জাফর ইকবালের ভৌতিক উপন্যাস “প্রেত” অবলম্বনে নির্মিত একই শিরোনামের ধারাবাহিক নাটকে। আহির আলমের নির্দেশনায় এখানে তার “রুমি” চরিত্রটির প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছিলেন স্বয়ং রচয়িতা জাফর ইকবাল।
সালাউদ্দিন লাভলুর ধারাবাহিক “রঙের মানুষ” এর “শহর আলী” চরিত্রে তার সাবলীলতা এখনও মনে রেখেছে নাট্যপ্রেমীরা। নাসির উদ্দীন ইউসুফ পরিচালিত “গেরিলা” (২০১১) সিনেমায় তার “শহীদ আলতাফ মাহমুদ” চরিত্রটি ভালবাসা পেয়েছিল সব বয়সী দর্শকদের।
২০১৪ সালে টলিউড ইন্ডাস্ট্রিতে তার রাজকীয় অভিষেক ঘটে সঞ্জয় নাগের “পারাপার” ছবির প্রধান ভূমিকায় অভিনয়ের মাধ্যমে। ২০২২-এ তাকে দেখা যায় প্রসূন রহমান পরিচালিত “প্রিয় সত্যজিৎ” সিনেমায়। বাংলার কিংবদন্তির চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে নির্মিত এই ছবিতে তার ভূমিকা ছিল একজন প্রবীণ চলচ্চিত্রকারের। চরিত্রটির জন্য তিনি ভারতের “জয়পুর আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব ২০২৩”-এর ফিচার ফিল্ম বিভাগে সেরা অভিনেতার পুরস্কার অর্জন করেন।
তার বর্ণাঢ্য অভিনয় জীবনের সর্বশেষ কাজ ছিল নুরুল আলম আতিকের পরিচালনায় “পেয়ারার সুবাস” চলচ্চিত্রটি।
শেষাংশ
আহমেদ রুবেলের খুব বেছে বেছে করা কাজগুলোর অধিকাংশই ছিল মনে রাখার মতো। জীবনকে সব সময় ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা এই গুণী শিল্পী সহজাতভাবে একটি স্বতন্ত্র অবস্থান সৃষ্টি করেছিলেন নাট্যজগতে। বৈচিত্র্যময় চরিত্রগুলোতে তার অবলীলায় মিশে যাওয়ার দক্ষতা বারবার নজর কেড়েছে দেশবরেণ্য নির্মাতাদের। এরকম আরও বর্ণীল অভিনয় উপহার দেওয়ার অপূর্ণ ইচ্ছে নিয়ে সবাইকে ছেড়ে পরপারে পাড়ি জমালেন এই পরিশ্রমী শিল্পী। এরপরেও আহমেদ রুবেলের জীবদ্দশার শ্রেষ্ঠ চরিত্রগুলো অমর হয়ে থাকবে তার গুণমুগ্ধ সহকর্মী ও ভক্তদের মাঝে।