অভিনেতা:
পরিচালক: মেজবাউর রহমান সুমন
ছবির ধরন:Bengali, Mystery, Psychological, Drama
সময়সীমা: 2 Hrs 10 Min
Hawa Film Review in Bengali: কোনও ছবি বাণিজ্যিকভাবে সফল হলেই যে তা ক্রিটিকদেরও বেশ পছন্দ হয়, এমন কিন্তু নয়! তাই যখন মূলধারার কোনও ছবি বাণিজ্যিকভাবে সফল হয়, আবার সমালোচকদেরও মন জিতে নেয়, তখন বুঝতে হয় সত্যিই সেই চলচ্চিত্রে বিশেষত্ব আছে! এই ছবি সমাজের সব স্তরের মানুষকেই ছুঁতে পারে। মেজবাউর রহমান সুমনের পরিচালিত ‘হাওয়া’ ঠিক এমনই। বাস্তব-অধিবাস্তব পরিসরের মধ্যবর্তী সূক্ষ্ম বিভাজন রেখা যেখানে ধীরে ধীরে মলিন হতে শুরু করে, ঠিক সেখানেই ‘হাওয়া’-এর সূত্রপাত। এর ন্যারেটিভ বা আখ্যান আপনাকেও এক ‘অদ্ভুত’ বাস্তবের মুখোমুখি করে। এই পরিসরে জীবনের গল্পও আছে, আবার রয়েছে উপকথার কাব্যিক দৃশ্যায়নও।
‘হাওয়া’ বহুচর্চিত এক বাংলা ছবি। তাই এই ছবির নতুন করে কোনও ইন্ট্রোডাকশন বা ভূমিকার প্রয়োজন নেই। আমরা সরাসরি ছবি নিয়েই আলোচনা শুরু করতে পারি। এই ছবির গল্প আহামরি নয়! খুব সাধারণ একদম চেনা এক প্রেম বা প্রতিশোধের গল্প বলা যেতে পারে। এরকম গল্প কারও মুখে শুনলে হয়তো আমাদের ভালোও লাগত না। তাহলে প্রায় ২ ঘণ্টা ধরে এই সাধারণ এক গল্প শোনার বা দেখার জন্যে দর্শককে আসনে বসিয়ে রাখলেন কী ভাবে পরিচালক? ঠিক এখানেই লুকিয়ে পরিচালকের মুনশিয়ানা। শুধু পরিচালকের মুনশিয়ানা বলা ভুল, এই ফিল্ম টিমের প্রত্যেকের অধ্যবসায় এবং কঠোর পরিশ্রমই এই অসাধ্যকে সাধন করে। ‘হাওয়া’ ছবিতে প্রশংসা করার মতো তিন থেকে চারটি বিষয় রয়েছে। এক এক করে তা নিয়েই আলোচনা শুরু করা যাক।
প্রথমেই এই ছবির পরিসর বা স্পেস নিয়ে কথা বলা জরুরি। মনে রাখতে হবে, ‘হাওয়া’-এর শ্যুটিংয়ের অধিকাংশই হয়েছে সমুদ্রে। ছবির চরিত্রদের নিয়ে মাসের পর মাস ট্রলারে শ্যুটিং করেছেন পরিচালক। এক্ষেত্রে তাঁদের বিভিন্ন বাধার মুখে পড়তে হয়েছে বারবার। সত্যি বলতে, মাঝ সমুদ্রে ট্রলারে শ্যুটিং করা কিন্তু খুব সহজও নয়! তবে এই টিমের পরিশ্রমের কাছে হার মানতে বাধ্য হয়েছে সব প্রতিকূলতাই।
ক্যামেরা বারবার সমুদ্রের অতল গভীরে ডুব দিয়েছে। আমাদেরও নিয়ে গিয়েছে এক জাদু বাস্তবে। তবে, দিগন্ত বিস্তৃত নীল জলের উপর মাছ ধরার ট্রলারের ওই ছোট্ট পরিসর কখনও দর্শকের কাছে একঘেয়ে হয়ে ওঠেনি। মাঝ সমুদ্রে এক্সপ্লোর করার মতো নানা স্বাদের সিনেম্যাটিক স্পেস পরিচালকের কাছে ছিল না ঠিকই, কিন্তু চমৎকার ক্রাফটম্যানশিপ এই খামতি দর্শককে মনে করার সুযোগও দেয়নি। সমসাময়িক বাংলা ছবিতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমরা যখন উচ্চ মধ্যবিত্তের বৈঠকখানার ঘুপচি পরিসর এবং গদগদ সংলাপের ভিড়ে ক্লান্ত, সেই সময়েই এক ভিন্ন স্বাদের ‘সিনেম্যাটিক স্পেস’-কে উপভোগ করার আনন্দ দেয় ‘হাওয়া’।
সিনেমা তৈরি করার জন্যে তার স্ক্রিন প্লে-ও খুব জোরদার হওয়া প্রয়োজন। যে কোনও ভালো ছবির মেরুদণ্ডের মতোই এটি। কোনও সাধারণ ন্যারেটিভকেও শুধুমাত্র সিনেম্যাটিক ল্যাঙ্গুয়েজের সাহায্যে অসাধারণ করে তোলা যায় এবং তার জন্যেও প্রয়োজন যথেষ্ঠ অধ্যবসায়। ‘হাওয়া’ ছবির প্রি-প্রোডাকশন এবং স্ক্রিন প্লে-তেই সেই আভাস পাওয়া যায়। ঠাস বুননের পোক্ত চিত্রনাট্য ছাড়া এমন সুন্দর ছবি তৈরি করা কখনও সম্ভব নয়, এই কথা স্বীকার করতেই হয়!
তৃতীয় যে বিষয়টি নিয়ে কথা না বললেই নয়, তা হল এই ছবির মিউজিক। ইমন চৌধুরীর সঙ্গীত পরিচালনায় ‘হাওয়া’-এর সামান্য ত্রুটিগুলিও যেন ঢাকা পড়ে যায়। ‘সাদা সাদা কালা কালা’ গানটি খুবই জনপ্রিয় হয়েছে। সমাজের সব স্তরের মানুষের কাছে পৌঁছে গিয়েছে এই গান। ইমনও সেই কথা এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন। তবে আলোচ্য বিষয় এই যে, একাধিক ‘নন মিউজিকাল ইনস্ট্রুমেন্ট’ ব্যবহারেই তৈরি করা হয়েছে এই গানের ট্র্যাক। কারণ, ছবির দৃশ্যে দেখা যায় যে, নৌকার মাঝিরা হাতের কাছে পাওয়া বিভিন্ন বস্তুকেই বাজিয়ে তৈরি সঙ্গীত রচনা করছেন। আনন্দে গান গাইতে শুরু করেছেন। সেই এসেন্সকে সঙ্গীতেও ধরে রাখতে চেয়েছিলেন পরিচালক। তাই এরকম একটি ট্র্যাক তৈরি করতে হয়েছিল ইমনকে। পুরনো গানকেই নতুনভাবে পরিবেশন করেছিলেন দর্শকদের কাছে। তার প্রভাব যে কতটা সুবিস্তৃত, সেই কথা আর নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই!
ছবির শুরুতেই চরিত্রদের সঙ্গেই দর্শকদের নৌকায় মাঝ সমুদ্রে নিয়ে চলেন পরিচালক। অজান্তেই আমরা যেন বাস্তব থেকে এক অধিবাস্তব পরিসরে ঝাঁপ দিই। তবে এই অধিবাস্তব পরিসরে রূপকথার ছোঁয়া নেই, এটি এক ডিসটোপিয়া। অসাধারণ কম্পোজিশন, আলোর ব্যবহার এবং ক্যামেরা ওয়ার্ককে বারবার কুর্নিশ জানাতে ইচ্ছে করে। আর ঠিক সেই কারণেই বাংলাদেশের এই বহুচর্চিত বাণিজ্যিকভাবে সফল ছবিটি পাড়ি দেয় ‘অস্কারের উড়ানেও’।
সবশেষে এই ছবির প্রত্যেক চরিত্রের অভিনয়ের প্রশংসা না করলেই নয়। চান মাঝির ভূমিকায় চঞ্চল চৌধুরি সত্যিই অনবদ্য। নিজেকে ভেঙে গড়ে ‘চান মাঝির’ ভূমিকায় তিনি নিজেকে প্রতিস্থাপিত করেছেন। তাঁর সংলাপ বলার ধরন, অভিনয় সব কিছুই অতুলনীয়। এই চঞ্চলের দিকে মুগ্ধ হয়ে শান্তভাবে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। ছবির অন্যান্য চরিত্রে যাঁরা অভিনয় করেছেন, তাঁরাও অসাধারণ।