পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা বলে রোগীকে শকের দিকে ঠেলে দেওয়া ঠিক হবে না, রোগীর অবস্থা গুরুতর মনে হলে স্টেরয়েড ওষুধটি প্রয়োগ করা উচিত।
অবাক করা বিষয় হলো, ডেঙ্গু শক সিনড্রম হলেও অনেকে স্টেরয়েড দিতে চান না বা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগেন। চলতি বছর মৃত্যুর সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে, ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা (এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত) ইতিমধ্যে ১৩০০ অতিক্রম করেছে। ২০২২ সালে ২৮১ জন মারা গিয়েছিল, আক্রান্ত ছিল ৬২ হাজারের কিছু বেশি। কিন্তু এবার আক্রান্তের সংখ্যা এরই মধ্যে আড়াই লাখেরও বেশি।
মৃত্যু ও আক্রান্তের হার ক্রমাগতভাবে বাড়তে থাকায় বিষয়টি আমাদের ভাবিয়ে তুলছে। এ পরিস্থিতিতে আমাদের চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীরা যথেষ্ট সচেতনতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে চিকিৎসা দিচ্ছেন, যা যা করা দরকার তার সবটুকুই করছেন। সমস্যা হলো, ডেঙ্গু শুধু শহরে সীমাবদ্ধ নেই, গ্রামেগঞ্জে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ছে। গ্রামে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ নেই। নানা সীমাবদ্ধতার কারণে ফ্লুইড ম্যানেজমেন্টও সুন্দরভাবে হচ্ছে না। ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনা ঘিরে বিতর্ক, পরস্পর দোষারোপের পাশাপাশি আছে নানা অভিযোগও।
আক্রান্তদের চিকিৎসা নিয়ে সবচেয়ে বেশি বিতর্ক হচ্ছে ডেঙ্গু শক সিনড্রম, এমনকি ডেঙ্গুজনিত অনেক জটিল রোগীদের স্টেরয়েড ওষুধটি প্রয়োগ নিয়ে। বাজারে বিভিন্ন ধরনের স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ আছে, একেকজন একেকটা প্রয়োগ করেন। এটা কোনো অসুবিধা নয়। সমস্যা হলো, স্টেরয়েড প্রয়োগ নিয়ে বিভিন্ন জনের বিভিন্ন রকম বক্তব্য এবং মতভেদ। অধিকাংশ চিকিৎসকই স্টেরয়েড ব্যবহার না করার পক্ষে। তবে একজন চিকিৎসক হিসেবে আমি মনে করি, ডেঙ্গু রোগী গুরুতর হলে বা কোনো জটিলতা দেখা দিলে অথবা এক্সপান্ডেড ডেঙ্গু সিনড্রমে জীবন রক্ষায় স্টেরয়েড প্রয়োগ করা উচিত। জীবন রক্ষাকারী বা লাইফ সেভিং ওষুধ হিসেবেই স্টেরয়েড ব্যবহার করা হয়। এটা কখন দেওয়া হয়, উত্তর হলো-মরণাপন্ন রোগীকে। সুতরাং এ নিয়ে বিতর্ক হওয়া নিষ্প্রয়োজন। এরপরও অনেকে এটা নিয়ে বিতর্ক করেন। কেউ এটা প্রয়োগ করেন, কেউ করতে চান না। অধিকাংশ চিকিৎসকেরই বক্তব্য হলো, স্টেরয়েড দেওয়া উচিত না, দিলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হবে। আমার কথা হলো, কোনো ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই? এন্টিবায়োটিক থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি ওষুধেরই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। এমনকি প্যারাসিটামলেরও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়া কোনো ওষুধই নেই।
স্টেরয়েড কখন প্রয়োগ করা উচিত
এখন আসুন, স্টেরয়েড প্রয়োগের সময় ও প্রাসঙ্গিকতায়। বিশেষ প্রয়োজনেই একজন রোগীকে এ জাতীয় ওষুধ দেওয়া হয়। তাহলে ডেঙ্গু রোগী গুরুতর বা জটিল হলে তা প্রয়োগ করা যাবে না কেন? অনেক জটিল ডেঙ্গু রোগী, যার ব্লাড প্রেসার এবং পালস পাওয়া যাচ্ছে না, অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে, হাত-পা ঠান্ডাÑএ রকম ভয়াবহ পরিস্থিতিতে এবং এক্সপান্ডেড ডেঙ্গু সিনড্রমে কোনো রকম কালক্ষেপণ করা যাবে না। এ সময় অবশ্যই স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ প্রয়োগ করতে হবে। এতে রোগীর জীবন রক্ষা পাবে। এ ব্যাপারে আমার প্রায় দুই যুগের অভিজ্ঞতা তাই বলে। সম্ভব হলে সতর্কতার অংশ হিসেবে গুরুতর পর্যায়ে চলে যাওয়ার আগেই রোগীকে স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ দেওয়া উচিত, এটা তার সুস্থতার জন্য অধিকতর বেশি সহায়ক।
আমার অভিজ্ঞতা হলো, রোগীর অবস্থা বুঝে ‘ডেক্সাম্যাথাসন’ ইনজেকশন শিরাপথে ১২ ঘণ্টা, আট ঘণ্টা বা ছয় ঘণ্টা পর পর চিকিৎসক রোগীর অবস্থা অনুযায়ী প্রয়োগ করলে হলে ভালো ফল পাওয়া যায়। এর সঙ্গে অন্যান্য চিকিৎসাও চলবে। স্টেরয়েড প্রয়োগের আরেকটি সুবিধা হলো, এটি ডেঙ্গু রোগীর প্লাটিলেট দ্রুত বাড়াতে সাহায্য করে। ফলে প্লাটিলেটও সঞ্চালনের প্রয়োজন পড়ে না। যদিও প্লাটিলেট প্রাকৃতিকভাবেই বাড়ে। তবুও স্টেরয়েড দিলে আমার মনে হয়, আরেকটু দ্রুত বাড়ে। এছাড়া স্টেরয়েড প্রয়োগ করলে রোগী ভালো বোধ করে, জ্বর কমে যায়, মাথাব্যথা, শরীর ব্যথা, গিরায় গিরায় ব্যথা কমে যায়, রোগীর রুচি বৃদ্ধি পায়। শ্বাসকষ্ট, পেটফোলা কমে আসে। সর্বোপরি রোগী ভালো বোধ করেন এবং তার মনোবল বাড়ে। গুরুতর অনেক ডেঙ্গু রোগীর ফ্লুইড লিকেজ হয়, অর্থাৎ শিরা বা ধমনী থেকে প্লাজমা বের হয়ে আসে, পেটে এবং বুকে পানি আসে। এ সময় স্টেরয়েড দিলে এগুলো শোষণ হয়ে যায়। এছাড়া রক্তক্ষরণের ক্ষেত্রেও স্টেরয়েড ব্যবহার করা যেতে পারে, সুতরাং এটা রোগীর জন্য খুবই সহায়ক।
ডেঙ্গুতেও স্টেরয়েড দেওয়া উচিত
স্টেরয়েড প্রয়োগ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও অনেক রোগের বেলায় কিন্তু ওষুধটি ব্যবহার করা হয়, ক্ষেত্রবিশেষে মাসের পর মাস। যে যুক্তিতে অন্য রোগীদের প্রয়োগ করা যায়, একই যুক্তিতে সংকটাপন্ন ডেঙ্গু রোগীদেরও এটা দেওয়া যাবে। এতে ভালো ফল পাওয়া যায়। কিন্তু চোখের সামনে রোগী মরে যাওয়ার দৃশ্য দেখার পরও স্টেরয়েড দেব না-এটা হতে পারে না। আমার কথা হলো, ভয়াবহ রোগীদের জীবন রক্ষায় এ সুযোগটি গ্রহণ করতে তো কোনো সমস্যা নেই। এটা তো নির্দিষ্ট চিকিৎসা না, বরং এটা আমরা রোগের লক্ষণের আলোকে (সিম্পমেটিক), সহায়ক (সাপোর্টিভ) হিসেবে দিয়ে থাকি। এর প্রয়োগে অনেক রোগীকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব।
প্রয়োগ করলেও অনেকে প্রকাশ করছেন না
অনেক চিকিৎসক স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ প্রয়োগ করলেও বলেন না। এ নিয়ে বিতর্ক থাকায় প্রয়োগের বিষয়টি তারা প্রকাশ করতে দ্বিধা করেন। আমার মনে হয়, রোগীর অবস্থা খারাপ হলে অবিলম্বে, নির্দ্বিধায় এটা দেওয়া উচিত। আমি কয়েক হাজার রোগী দেখেছি, যাদের দিয়েছি, তারা সবাই ভালো আছেন। রোগী একবার ডেঙ্গু শকে চলে গেলে তো বাঁচানো কঠিন। রোগীর অবস্থা একটু খারাপ হলেই ওষুধটি ব্যবহার করা উচিত। অনেকে বলেন, স্টেরয়েড দিলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। কিন্তু শকে তো রোগী প্রায় মরণাপন্ন, সেখানে আবার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার প্রশ্ন কোথা থেকে আসে?
হাস্যকর একটি কথা প্রচলিত আছে, রোগী মারা গেলেও চোখটা রক্ষা পেয়েছে। আমার কথা হলো, একজন রোগী মারা গেলে তার চোখ বাঁচিয়ে লাভ কী? চোখের আগে তো রোগীকে বাঁচাতে হবে। সুতরাং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থেকে সুরক্ষা দিতে গিয়ে রোগীকে শকের দিকে ঠেলে দেওয়া ঠিক হবে না, গুরুতর মনে হলে বা এর আগেই স্টেরয়েড প্রয়োগ করা উচিত। কেউ কেউ বিষয়টি দেরিতে প্রকাশিত হওয়ার বিষয়ে আমাকে প্রশ্ন তুলেছেন। ব্যাপক সংখ্যক রোগীকে ওষুধটি সন্তোষজনক হওয়ায় এখন আমার কাছে প্রকাশযোগ্য মনে হয়েছে। এটা আমার অবজারভেশনাল স্টাডি এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে যুক্তিযুক্ত মনে করছি।
অনেক দেশে ডেঙ্গু রোগীকে স্টেরয়েড প্রয়োগ
বিদেশের অনেক চিকিৎসকের সঙ্গে আমি কথা বলেছি, তারা জানিয়েছেন, তাদের স্টেরয়েড প্রয়োগের ফলাফল খুবই ভালো। ফলে তারা নির্দ্বিধায় দিচ্ছেন। সুতরাং আমি মনে করি, এটা নিয়ে একদিকে গবেষণা হতে পারে, অন্যদিকে মরণাপন্ন রোগীদের জীবন রক্ষায় এর ব্যবহার অব্যাহত থাকুক। ডেঙ্গু রোগীদের আমরা গতানুগতিক চিকিৎসা দিচ্ছি। মৃত্যুর মিছিল তো থামছে না, সুতরাং সেখান থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। আমি মনে করি, ভয়ভীতি উপেক্ষা করে সাহসী উদ্যোগ নিয়ে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ হিসেবে এটা প্রয়োগ করা যেতে পারে। জটিল রোগীর বেলায় সময়ক্ষেপণ না করে স্টেরয়েড প্রয়োগ করা হলে অনেক জটিল ডেঙ্গু রোগী সুস্থ হয়ে যাবে। কিছু কিছু রোগে যেমন এসএলই পেমমফিগাছ, ডার্মাটোমায়োসাইটিস রোগীকে চিকিৎসকরা মাসের পর মাস স্টেরয়েড দিয়ে থাকেন। দীর্ঘমেয়াদি স্টেরয়েড ব্যবহারে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে।
তবে ডেঙ্গু রোগীর বেলায় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়াসহ অন্যান্য ক্ষতির আশঙ্কা নেই। কারণ এটা দীর্ঘমেয়াদি না, বরং সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য ব্যবহার করা হয়, ৪-৫ দিন ব্যবহারে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই, তেমন কোনো জটিলতা দেখা দেবে না। বরং অধিকাংশ রোগী আরোগ্য লাভ করবে। তবে সতর্কতার জন্য আমার পরামর্শ হলো কোনো রোগী ডাক্তারের পরামর্শ ব্যতীত ফার্মেসি থেকে নিজের মতো করে ওষুধটি কিনে অবশ্যই ব্যবহার করবেন না। অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিবেন।
লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক।