হাজার হাজার সৈন্য নিয়ে গাজা উপত্যকায় স্থল অভিযানের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে ইসরায়েল। তাদের লক্ষ্য, গাজা সিটি দখল করে নেওয়া এবং উপত্যকার বর্তমান শাসক হামাসের নেতৃত্বকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করা। তিনজন জ্যেষ্ঠ ইসরায়েলি সামরিক কর্মকর্তার বরাতে এ তথ্য প্রকাশ করেছে দ্য নিউইয়র্ক টাইমস।
শনিবার (১৪ অক্টোবর) এক বিশেষ প্রতিবেদনে মার্কিন সংবাদমাধ্যমটি জানিয়েছে, ২০০৬ সালের লেবানন যুদ্ধের পর ইসরায়েলের জন্য এটাই হবে সবচেয়ে বড় স্থল অভিযান। পাশাপাশি, ২০০৮ সালের পর এই প্রথমবার গাজার ভূমি দখলের (সাময়িক সময়ের জন্যে হলেও) চেষ্টা করছে ইসরায়েলি বাহিনী, বলেছেন ওই তিন কর্মকর্তা।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী (আইডিএফ) এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে গাজায় স্থল অভিযান শুরুর ঘোষণা দেয়নি। তবে ইসরায়েলি সৈন্যদের কয়েকটি দল গত শুক্রবার উপত্যকায় প্রবেশ করেছিল এবং সৈন্যরা স্থল অভিযানের জন্য প্রস্তুতি বাড়িয়েছে বলে স্বীকার করেছে আইডিএফ।
গুলি করতে বাধা নেই
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গাজায় স্থল অভিযান ‘সহজতর’ করার লক্ষ্যে সন্দেহভাজনদের দিকে গুলি চালানোর আগে তল্লাশির বাধ্যবাধকতা শিথিল করেছে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী। অর্থাৎ, কাউকে সন্দেহ হলে খুব বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই তার দিকে গুলি চালাতে পারবে ইসরায়েলি সৈন্যরা।
তারা জানিয়েছেন, এই সপ্তাহান্তেই (শনি-রোববার) গাজায় অভিযান শুরুর পরিকল্পনা ছিল ইসরায়েলের। কিন্তু বিরূপ আবহাওয়ায় ইসরায়েলি পাইলট ও ড্রোন অপারেটরদের জন্য স্থল সৈন্যদের সাহায্য করা কঠিন হয়ে যাওয়ায় অভিযান পিছিয়ে দেওয়া হয়।
গাজায় অভিযানে সৈন্যদের পাশপাশি ইসরায়েলি বাহিনীতে থাকবে বিপুল সংখ্যক ট্যাংক, স্যাপার ও কমান্ডো। আকাশপথে যুদ্ধবিমান, হেলিকপ্টার ও ড্রোনের সাহায্যে সুরক্ষা দেওয়া হবে সৈন্যদের।
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রধান মুখপাত্র রিয়ার অ্যাডমিরাল ড্যানিয়েল হাগারি শনিবার বলেছেন, তাদের লক্ষ্য হামাসকে ধ্বংস ও তার নেতাদের নির্মূল করা।
বেসামরিক লোকদের কী হবে
ইসরায়েলি হামলায় এরই মধ্যে গাজা উপত্যকায় ভয়াবহ মানবিক সংকট তৈরি হয়েছে। ইসরায়েলের স্থল অভিযানে চিরতরে ঘরছাড়া হওয়ার আশঙ্কা করছেন বহু ফিলিস্তিনি।
ইসরায়েলি বাহিনীর দাবি, তারা যথাসম্ভব বেসামরিক প্রাণহানি এড়ানোর চেষ্টা করছে। এ জন্য গাজা সিটির বাসিন্দাদের উপত্যকার দক্ষিণ অংশে চলে যাওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
গত এক সপ্তাহে গাজায় ইসরায়েলি হামলায় ২ হাজার ২০০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছেন। এদের মধ্যে ৭০০ জনেরও বেশি শিশু। এমনকি উত্তর গাজা ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে বেরোনো মানুষদের ওপরও বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। শুক্রবারের ওই হামলা নিহতদের একটি বড় অংশই ছিল শিশু ও নারী।
ইসরায়েলের রিচম্যান ইউনিভার্সিটির ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর কাউন্টার-টেরোরিজমের পরিচালক ও ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা মিরি আইসিন বলেছেন, জিম্মিদের কাছে যাওয়ার একমাত্র উপায় হলো স্থল অভিযান। কিন্তু অভিযান শুরু হলে ‘সন্ত্রাসীরা’ জিম্মিদের বিস্ফোরিত করে আমাদের নিষ্ঠুর দেখানোর চেষ্টা করতে পারে।
দক্ষিণ গাজার কী হবে
এক জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, গাজার উত্তরাঞ্চলের মতো দক্ষিণাঞ্চলও দখলে নেওয়া হবে কি না সে বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত নেয়নি ইসরায়েলের সরকার। কিন্তু দক্ষিণ গাজা ইসরায়েলি নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকলে হামাসের কিছু নেতা অধরা থেকে যেতে পারেন বলে মনে করেন তিনি।
ইসরায়েলি সরকারের সাবেক জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক ও নিরাপত্তা উপদেষ্টা নিমরোদ নোভিক বলেছেন, ইসরায়েলের কিছু সামরিক ও রাজনৈতিক নেতা চান, সৈন্যরা অন্তত ১৮ মাস ধরে গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনিদের ঘরে ঘরে গ্রেফতার অভিযান পরিচালনা করুক। অন্যরা মনে করেন, হামাসকে ধ্বংস করা নয়, বরং তাদের হুমকি দেওয়ার ক্ষমতাটুকু কেড়ে নেওয়া হোক।
হামাস না থাকলে গাজা চালাবে কে
হামাস নির্মূল হলে গাজা চালাবে কে, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে বিশ্লেষকদের মনে। কেউ কেউ বলছেন, ১৯৬৭ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত উপত্যকাটি যেভাবে সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করতো ইসরায়েল, তেমনটি আবারও করতে পারে। কিন্তু প্রতিকূল মনোভাবসম্পন্ন ২২ লাখ গাজাবাসীকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিনই হবে ইসরায়েলের জন্য।
এ অবস্থায় ইসরায়েলি কূটনীতিকদের মধ্যে একটি আলোচনা বেশ জোরেশোরে চলছে যে, পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের হাতে ফের গাজার নিয়ন্ত্রণ তুলে দেওয়া হোক। ২০০৭ সালে তাদের হটিয়েই গাজা নিয়ন্ত্রণে নিয়েছিল হামাস।
কিন্তু এতেও ঝুঁকি রয়েছে। পশ্চিম তীরের রামাল্লাহভিত্তিক ফিলিস্তিনি বিশ্লেষক ইব্রাহিম দালালশার কথায়, এ ধরনের পদক্ষেপে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে ইসরায়েলের হাতের পুতুল মনে হতে পারে। কারণ, হামাস নির্মূল হওয়ার পরে তারা (পশ্চিম তীরের কর্তৃপক্ষ) গাজায় আসবে ইসরায়েলি ট্যাংকে চড়ে।