ফৌজদারি অভিযোগে আদালতে মামলার আবেদন করা হলে সাধারণত পুলিশকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। পুলিশের প্রতিবেদন সাপেক্ষে আদালত আইনগত ব্যবস্থা নেয়। কিন্তু সম্প্রতি পুলিশ হেফাজতে মারা যাওয়া দুদকের সাবেক কর্মকর্তা শহীদুল্লাহর ক্ষেত্রে এমনটা ঘটেনি। তার ক্ষেত্রে পুলিশি তদন্ত ছাড়াই আদালত প্রথমে সমন এবং পরে ওয়ারেন্ট জারি করেন। আবার আদালতের বেঞ্চ সহকারীর চালাকির কারণে আসামি সমনও পাননি। উল্টো তাকে ওয়ারেন্ট দেখিয়ে আকস্মিকভাবে গ্রেপ্তার করা হয়।
শহীদুল্লাহর মৃত্যুর পর এসব বিষয় সামনে এসেছে। এমনকি তথ্য এসেছে, তার বিরুদ্ধে করা মামলাটিই ছিল মিথ্যা। এসব অনিয়ম ও অসঙ্গতির বিষয়টি খতিয়ে দেখতে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠনের দাবি উঠেছে।
চট্টগ্রামের আদালত সূত্রে জানা গেছে, গত ২৯ আগস্ট দুদকের সাবেক কর্মকর্তা ছৈয়দ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ ও তার শ্যালক মোহাম্মদ কায়সার আনোয়ারের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেন রনি আক্তার তানিয়া নামে এক নারী। মামলার অভিযোগে তিনি বলেন, সাড়ে ৬ হাজার টাকা বকেয়া আদায় করতে তিনি শহীদুল্লাহর বাসায় যান। তার সঙ্গে কলি আক্তার নামে আরেক নারীও ছিল। পাওনা টাকা দেওয়ার পরিবর্তে শহীদুল্লাহ ও তার শ্যালক তাকে মারধর করেন এবং পরবর্তীতে আবার টাকা চাইতে গেলে মেরে ফেলার হুমকি দেন।
মামলার অভিযোগ শুনে বিচারক ওইদিনই অপরাধ আমলে নিয়ে অভিযুক্ত দুজনের বিরুদ্ধে সমন জারি করেন। অর্থাৎ আদালতে হাজির হতে বলেন।
অভিযোগ উঠেছে, ওই সমন সংশ্লিষ্ট আদালতের বেঞ্চ সহকারী হারুন অর রশীদ গায়েব করে ফেলেন। ফলে আসামিরা আদালতে হাজির হওয়ার কোনো সমন পাননি। এরপর মামলার পরবর্তী তারিখ দেন আদালত। ওই তারিখে মামলার বাদী হাজির না হওয়ায় তার আইনজীবী সময়ের আবেদন করেন। কিন্তু ওইদিনই আদালত দুই আসামির বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট জারি করে দেন। যা কিছুটা অস্বাভাবিক পদক্ষেপ ছিল। এরপর গত ৩ অক্টোবর দিবাগত রাতে শহীদুল্লাহকে আদালতের ওয়ারেন্ট দেখিয়ে গ্রেপ্তার করে চান্দগাঁও থানা পুলিশ। গ্রেপ্তারের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে শহীদুল্লাহ মারা যান।
মামলাটি ছিল মিথ্যা : বাদী
পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর পর দুদক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাটি মিথ্যা বলে দাবি করেছেন খোদ মামলার বাদী রনি আক্তার তানিয়া।
তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, মামলাটি সাজানো ছিল। আমি উকিলের শেখানো কথামতো আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে মিথ্যা গল্প বলে মামলা দায়ের করেছি। চান্দগাঁও থানার স্থানীয় দুই রাজনৈতিক নেতার কথায় আমি শহীদুল্লাহর বিরোধপূর্ণ জায়গায় উঠি। তবে ওঠার আগে জানতাম না ওই জায়গা নিয়ে ঝামেলা আছে। এরপর নানা প্রলোভন দেখিয়ে স্থানীয় ওই দুই নেতা আমাকে আদালতে নিয়ে শহীদুল্লাহর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলাটি দায়ের করান।
সমন গায়েব করে ওয়ারেন্ট!
ভুক্তভোগী শহীদুল্লাহর ছেলে ক্যাপ্টেন নাফিস শহীদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার বাবার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে আমরা জানি না এবং জানার কথাও না। কারণ আদালত সরাসরি মামলা দায়েরের দিনই (২৯ আগস্ট) সমন দিয়ে দিয়েছে। এরপরের তারিখে বাদী সময়ের আবেদন করলেও বিচারক ওয়ারেন্ট দিয়ে দিয়েছেন। পরে আমরা আদালতে খবর নিয়ে জানলাম প্রথমদিন জারি করা সমনটি আদালতের নেজারত শাখায় পৌঁছেনি। অর্থাৎ সেটি পেশকারের হাতেই ছিল। কিন্তু ওয়ারেন্ট জারি হওয়ার পর সঙ্গে সঙ্গে সেটি থানায় পৌঁছে যায়।
তিনি আরও বলেন, আদালতের আদেশে কোনো পুলিশ কর্মকর্তা ওয়ারেন্ট তামিল করলে সাধারণত পোশাক পরে ফোর্স নিয়ে যায়। কিন্তু আমার আব্বার ক্ষেত্রে সাদা পোশাকে রাতের বেলা ওয়ারেন্ট তামিল করা হয়েছে। আমাদের কাউকে জানানোও হয়নি। এলাকাবাসী না দেখলে আমার আব্বাকে গুম করে ফেললেও আমরা খবর পেতাম না। এলাকাবাসী খবর দেওয়ায় আমার চাচারা থানায় গিয়ে খবর নেন। কিন্তু থানায় পুলিশ কর্মকর্তারা চাচাদের আব্বার সঙ্গে দেখা করতে দেয়নি। তারা থানার কলাপসিবল গেট বন্ধ করে দেয়। বাবা হার্টের পেশেন্ট ছিলেন, তাকে ইনহেলার দিতে হয়। পুলিশ কর্মকর্তারা সে ওষুধও বাবাকে গ্রহণ করতে দেননি।
বৈমানিক নাফিস শহীদ আরও বলেন, বাবা মারা যাওয়ার পর আমরা এখনো শোক কাটিয়ে উঠতে পারিনি। এখন আমরা পারিবারিকভাবে বসে আলোচনা করব। মিথ্যা মামলায় সমন লুকিয়ে ওয়ারেন্ট জারি এবং পুলিশ হেফাজতে বাবার মৃত্যুর বিষয়টি নিয়ে আমরা আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
যা বলছেন আইনজীবীরা
দুদক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলাটি নিয়ে অন্তত ১০ জন আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলেন ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদক। তাদের সঙ্গে কথোপকথনের রেকর্ড সংরক্ষিত আছে। তবে বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন হওয়ায় কোনো আইনজীবী প্রকাশ্যে মন্তব্য করতে রাজি হননি।
আইনজীবীরা জানিয়েছেন, দুদক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যে ফৌজদারি অভিযোগটি দায়ের করা হয়েছে সেটিতে দণ্ডবিধি আইনের ৩২৩, ৩২৪, ৩০৭, ৩৫৪, ৫০৬(২)/৩৪ ধারার অভিযোগ আনা হয়েছে। বিচারক দুটি অ-আমলযোগ্য ধারা ৩২৩ এবং ৫০৬ ধারার অপরাধ আমলে নিয়ে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সমন জারি করে দেন। এর মধ্যে ৩২৩ ধারার অপরাধ মানে হালকা মারধর এবং ৫০৬ ধারার অপরাধ মানে হুমকি।
আইনজীবীরা জানিয়েছেন, সাধারণত বাবা-মা যদি সন্তানদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন তাহলে বিচারক সরাসরি অপরাধ আমলে নিয়ে সমন কিংবা ওয়ারেন্ট দিয়ে থাকেন। অন্য প্রায় সবক্ষেত্রে প্রথমে অভিযোগটি থানা পুলিশ কিংবা পুলিশের বিভিন্ন সংস্থা দিয়ে তদন্ত করান। এরপর পুলিশ অভিযুক্তদের নাম-ঠিকানা এবং ঘটনা তদন্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দেয়। আদালত অপরাধ গুরুতর হলে আসামিদের বিরুদ্ধে সরাসরি পরোয়ানা অথবা সমন দিয়ে থাকেন। কোনো আসামি একবার বা ততোধিকবার সমন অনুযায়ী আদালতে হাজির না হলে এরপর ওয়ারেন্ট বা পরোয়ানা জারি করেন।
বাদী করলেন সময়ের আবেদন, আদালত দিলেন পরোয়ানা!
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আইনজীবী ঢাকা পোস্টকে বলেছেন, দুদক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুটি ধারায় সরাসরি অপরাধ আমলে নেওয়া মানে হলো মামলা রুজুর দিনই শিশু থেকে পরিণত অবস্থায় নিয়ে গেছে। আবার সেই সমনের একমাস না পেরোতেই ওয়ারেন্ট জারি করা হয়েছে। অবাক করার বিষয় হলো যেদিন ওয়ারেন্ট জারি করা হয়েছে, সেদিন আদালতে বাদী উপস্থিত ছিলেন না। ওইদিন তিনি করেছেন সময়ের আবেদন। কিন্তু আদালত বাদীর উপস্থিতি ছাড়াই তড়িঘড়ি করে ওয়ারেন্ট জারি করেন।
সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবী বলেন, এখানে কোনো দুষ্কৃতকারী জড়িত হয়ে আদালতকে ব্যবহার করেছেন। কারণ মামলার বাদী ইতোমধ্যে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, জানিয়েছেন তিনি মিথ্যা মামলা করেছেন। আদালত বিষয়টি তদন্ত করতে দিলে কোনো প্রশ্নই উঠত না। এখন তো নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কারণ বিচারক কীভাবে তদন্ত ছাড়া নিশ্চিত হলেন ভুক্তভোগী মারধরের শিকার হয়েছেন এবং তাকে হুমকি দেওয়া হয়েছে। আবার সমন জারির জন্য আরও দুয়েকবার সময় দেওয়া যেত।
এই আইনজীবী আরও বলেন, আদালতের আদেশ পেয়ে পুলিশও তড়িঘড়ি করে পরোয়ানা তামিলে নেমে পড়েছেন। এ থেকে বোঝা যায়, মামলাটিতে কারও না কারও স্বার্থ জড়িত ছিল।
বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি
অ্যাডভোকেট মো. শহীদুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আরেকটি বিষয় হলো এখানে আদালতের দেওয়া সমন আসামিরা পাননি। তাহলে মাঝখানে কেউ সমন গায়েব করেছে কি না সেটি তদন্ত করা উচিত। বিচার বিভাগীয় তদন্ত হলে বিষয়টি বের হয়ে আসবে। কারণ আজ একজনের ক্ষেত্রে হয়েছে, এভাবে চললে সামনে আরেকজন ভুক্তভোগী হবে। এজন্য আমি চাই বিষয়টি নিয়ে তদন্ত হোক।
পরোয়ানা তামিলকারী দুই এএসআইকে জিজ্ঞাসাবাদ
আদালতের আদেশে ৩ অক্টোবর দিবাগত রাতে পরোয়ানা তামিল করেছেন চট্টগ্রামের চান্দগাঁও থানার দুই সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) মো. ইউসুফ আলী ও এটিএম সোহেল রানা। ইতোমধ্যে দুজনকে প্রত্যাহার করে পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করা হয়েছে। দুদক কর্মকর্তার পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু এবং তাকে গ্রেপ্তারে বিধি-বহির্ভূত কাজ হয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখতে একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করেছে পুলিশ। এতে প্রধান করা হয়েছে নগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) উত্তর ও দক্ষিণ জোনের উপ-কমিশনার (ডিসি) নিহাদ আদনান তাইয়ানকে।
নিহাদ আদনান ঢাকা পোস্টকে বলেন, তদন্ত শুরু হয়েছে। অভিযুক্ত দুই এএসআইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। আমাদের ৩ দিনের সময় দেওয়া হয়েছিল। তবে তদন্তের স্বার্থে আমরা আরও ৩ দিন সময় চেয়েছি। তদন্ত চলমান অবস্থায় কোনো মন্তব্য করা যাচ্ছে না।
সেই বেঞ্চ সহকারীকে বদলি
পুলিশ হেফাজতে দুদক কর্মকর্তা মারা যাওয়ার পর যে আদালত থেকে সমন লুকিয়ে ওয়ারেন্ট জারি করা হয়েছিল বলে অভিযোগ উঠেছে সেটির বেঞ্চ সহকারী হারুন অর রশীদকে বদলি করা হয়েছে। গত ৮ অক্টোবর চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. রবিউল আলমের আদেশে তাকে বেঞ্চ সহকারী পদ থেকে ক্যাশিয়ার পদে বদলি করা হয়। একই সঙ্গে এ ঘটনা খতিয়ে দেখতে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট অলি উল্লাহকে নিয়ে এক সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।